খান মোঃ কামরুল: এটি কার যেন উক্তি : ‘জীবনটা কী সবে জানতে শিখেছি, ততক্ষণে যাবার সময় হয়ে এসেছে।’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করেন। প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে তিনি হন রাষ্ট্রপতি। শিক্ষাব্যবস্থাসহ এরশাদের শাসনামলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশে ও বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার কোনো শেষ নেই। এ সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়নে সরকার গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যা সব মহলে খুব প্রশংসিত হয়।
১৯৮৩ সালের মাধ্যবর্তী (সম্ভবত জুন মাসে) সরকার বেসরকারি শিক্ষকদের ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তটি এই যে এখন থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ উপযুক্ত বিবেচিত হলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বা গভর্নিং বডি কর্তৃক ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত পূর্ববর্তী নিয়মকানুন অনুযায়ী দুই বছর করে ও সবশেষে এক বছরের জন্য (২+২+১) পুনরায় নিযুক্ত হতে পারবেন (এর আগে ব্যবস্থাটি এমনই ছিল এবং মধ্যে অনেক বছর বন্ধ ছিল বলে জানা যায়)।
একই সঙ্গে ৬০ বছরের পরবর্তী মেয়াদে পুনর্নিযুক্তির জন্য শিক্ষকগণ সরকারি তহবিল থেকে কোনো রকমের আর্থিক সুবিধাদি পাবেন না বলেও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এমন একটি সিদ্ধান্তের ফলে বেসরকারি শিক্ষকরা এই ভেবে আশ্বস্ত হন যে, আর্থিক সুবিধাদি যা হোক, জীবনসায়াহ্নে তবুতো কিছুটা হলেও স্বীকৃতি পাওয়া গেল। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বয়সে প্রবীণ ও কর্মে দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে আরো কিছুদিন সেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো।
নিঃসন্দেহে এতে সমাজেরই উপকার। এরশাদ সরকার গৃহীত এই বিধানটি কোনো রকমের ব্যত্যয় ছাড়া তার পুরো আমল, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি শাসনামল (১৯৯১-১৯৯৬), শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকারের আমল (১৯৯৬-২০০১), বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ঐক্যজোট সরকারের আমল (২০০১-২০০৬),
ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল (২০০৭-২০০৮) ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম (২০০৮-২০১৩) ও পরবর্তী আমলে (২০১৪-২০১৮) অক্ষুণ্ন থাকে। তার মানে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকরা ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষকতা করার পরও বিধি ও শর্ত অনুযায়ী আরো পাঁচ বছর শিক্ষকতা করার সুযোগ পান, যা বিরতিহীন ৩৫ বছর (১৯৮৩-২০১৮) অব্যাহত থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আগের সরকার (২০১৪-২০১৮) ২০১৮ সালের ১২ জুন আকস্মিক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৬০ বছরের পর পুনর্নিযুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। ঐ নির্দেশনায় বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী যাদের ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে; এখন থেকে তাদের পুনরায় আর নিযুক্ত করা যাবে না। জারি করা প্রজ্ঞাপনটির ১১(৬) ধারা অনুযায়ী—
‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিতে প্রথম প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর। …..শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রদেয় হবে। বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হবার পর কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান প্রধান/সহ:প্রধান/শিক্ষক-কর্মচারীকে কোনো অবস্থাতেই পুনর্নিয়োগ কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।’
সরকারের এমন একটি সিদ্ধান্ত বা আদেশ জারি হওয়ার পর সর্বস্তরের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েন।
একটি বিষয় খুবই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এরশাদের শাসনামলের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকতে পারেন। রয়েছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে ৩০ ও অবসরগ্রহণে ৫৯ বছরের ব্যবস্থা। অবশ্য এইরূপ বয়স বৃদ্ধির পেছনে যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে। গত তিন-চার দশকে আমাদের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। ফলে আগের তুলনায় সবার কর্মক্ষমতাও বেড়েছে। বেড়েছে দেশে কর্মহীন শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সংখ্যা।
অন্যদিকে গত তিন-চার দশক ধরে সরকারি কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। অবসরগ্রহণের ঠিক আগমুহূর্তে চাকরির মেয়াদ এক বছর বা দুই বছর বাড়িয়ে বিভিন্ন দপ্তর বা বিভাগে তাদেরকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হলে তা বাড়িয়ে দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় বারের মতো মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
এতে চাকরিরত কনিষ্ঠদের পদোন্নতিতে ব্যাঘাত বা বঞ্চনার সৃষ্টি হওয়ায় তারা বরাবরই অসন্তুষ্ট; কিন্তু ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অভিজ্ঞদের সেবাগ্রহণের’ যুক্তি দেখিয়ে একেকটি সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রথাটিকে বহাল রেখে চলেছে; কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায় এ কী আজব ব্যবস্থা! টানা ৩৫ বছর পর্যন্ত ৬৫ বছরের সুযোগ বা অধিকার ভোগ করার পর আকস্মিক ৬০ বছরের সীমানায় শিক্ষকদের আবদ্ধ করে ফেলা! সারা দেশে ৩৫ হাজারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যাটি ৫ লাখের বেশি।